
পাঁচ দিনব্যাপী ৭৭তম ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা গত ১৯ অক্টোবরর শেষ হয়েছে। এটি একাধারে বই ও বই-সম্পর্কিত সকল বিষয়ের আন্তর্জাতিক সমাবেশ। বই, জার্নাল, ডিজিটাল প্রকাশনা ও তার প্রযুক্তি, লেখক, সাহিত্যিক এজেন্ট, অনুবাদক, সম্পাদক, মুদ্রণকারী– এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যা এই মেলায় অন্তর্ভুক্ত নয়। পাঁচ হাজারেরও বেশি স্টলে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে এ মেলা পরিণত হয় জ্ঞানের এক বিশাল উৎসবে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে প্রতিবছরই এই মেলায় শত শত সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করেছে। তবে বইমেলায় কিছু অর্জন করতে হলে, আগে স্পষ্ট করতে হবে কেন আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অংশগ্রহণ করছি। উদ্দেশ্য কি– বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতকে বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত করা, বই বিক্রি করা, নাকি বইয়ের কপিরাইট বিক্রি করা? যে উদ্দেশ্যই হোক, তা পূরণ করা সম্ভব নয় কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া। বাংলাদেশ বহু বছর ধরে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অংশ নিচ্ছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান অর্জনের উদাহরণ পাওয়া যায়নি। কপিরাইট বিক্রি হয় মূলত লিটারারি এজেন্টদের মাধ্যমে, যারা বছরজুড়ে বিদেশি প্রকাশকদের কাছে বই প্রচার করে। আরেকটি উপায় হতে পারে– তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য প্রকাশে আগ্রহী বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের কাছে বাংলাদেশের বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাঠানো। বাংলাদেশি বই বিক্রির সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে সীমিত, কারণ ইংরেজি ভাষায় আমাদের প্রকাশনার পরিসর এখনো ছোট। তবে দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্র ও জার্নাল আন্তর্জাতিকভাবে বিক্রির সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে।
জানা যায়, বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে কৃষি বিষয়ক জার্নাল বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে আসছে। ভারতের তামিলনাড়ু সরকার ‘চেন্নাই আন্তর্জাতিক বইমেলা’র মাধ্যমে তামিল ভাষার বই বিদেশি ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশের জন্য অনুদান প্রদান করে। ফলে চেন্নাই বইমেলা আজ সত্যিকার অর্থে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরিণত হয়েছে।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রায় প্রতি বছর ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় সেমিনার আয়োজন করে; কিন্তু যাদের জন্য সেগুলো করা হয়– তাদের উপস্থিতি খুবই সীমিত বা একেবারেই থাকে না। প্রশ্ন হলো, তাহলে এই সেমিনারগুলোর উদ্দেশ্য কী? প্রথম তিন দিনে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার সেমিনার হয়, যেগুলো তাদের অফিসিয়াল প্রোগ্রাম তালিকায় থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের সেমিনারগুলোর কোনো উল্লেখ বা প্রতিফলন দেখা যায় না।
এ ধরনের সেমিনার ফলপ্রসূ করতে হলে তিন–চার মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আলোচক হিসেবে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে কর্মরত অধ্যাপক, বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহী গবেষক ও লেখকদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। সবশেষে, যদি সরকারি উদ্যোগে অংশগ্রহণ করা হয় কিন্তু প্রকাশকরা সম্পৃক্ত না থাকেন, তবে এই অংশগ্রহণের কোনো বাস্তব সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। আমি নিজে দেখেছি, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন খুব ছোট বুথ নিয়ে বইমেলায় অংশ নেয়– তারা সরকারি উদ্যোগে এলেও সঙ্গে প্রকাশকদের নিয়ে আসে, বিদেশি প্রকাশক ও ক্রেতাদের সঙ্গে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। আজ সেই দেশগুলোই ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ‘গেস্ট অব অনার’ হওয়ার মতো মর্যাদা অর্জন করেছে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, শুদ্ধস্বর ডটকম
আপনার মতামত লিখুন :